আব্দুস সামাদ লালমনিরহাট
মানুষের অন্তর খুব দ্রুত পরিবর্তনশীল । মানুষ আজ যাকে ভালোবাসে -কাল তাকে ঘৃণা করে, আবার আজ যে জানের দুশমন -কাল সে ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয় । মানুষের অন্তর বা হৃদয়কে আরবীতে “ক্বালব” বলা হয়, আর ক্বালব শব্দের অর্থই হচ্ছেঃ যা খুব দ্রুত পরিবর্তনশীল । বিশ্বনবী মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ “ক্বালব (মানুষের অন্তরকে) বলা হয় তা বেশি বেশি পরিবর্তন হওয়ার কারণে । মানুষের অন্তরের উদাহরণ হচ্ছে, যেন একটি পাখির পালকের মতো যা গাছের ডালে ঝুলানো আছে, বাতাস সেটিকে ইচ্ছেমতো এদিক-সেদিক ঘুরাচ্ছে ।” আহমাদঃ ৪/৪০৮, সহীহ আল-জামিঃ ২৩৬৫। আখেরী নবী রাসুলুল্লাহ ﷺ আরো বলেছেনঃ “আদম সন্তানের অন্তর ফুটন্ত পানির পাতিলের চাইতে দ্রুত পরিবর্তনশীল ।” যিলালুল জান্নাহ, শায়খ আলবানী রহি’মাহুল্লাহ মানুষের অন্তর দ্রুত পরিবর্তন হয়ে যায়, এইজন্য আমাদের অন্তর যেন আল্লাহর প্রতি ঈমান ও আনুগত্য থেকে সরে গিয়ে কুফুরী, শিরক, মুনাফেকী কিংবা ফাসেকীর দিকে চলে না যায় সেইজন্য সালাতের প্রত্যেক রাকাতে সুরা ফাতেহার মাঝে এই দুআ করা আল্লাহ আমাদের জন্য ফরয করে দিয়েছেনঃ ٱهۡدِنَا ٱلصِّرَٰطَ ٱلۡمُسۡتَقِيمَ ٦ “(হে আল্লাহ!) আমাদেরকে সহজ সরল-সঠিক পথ দেখাও।” সুরা আল-ফাতিহাঃ ৬ এছাড়াও সালাতের বাহিরে রাসুলে আকরাম ﷺ يَا مُقَلِّبَ الْقُلُوبِ ثَبِّتْ قَلْبِي عَلَى دِينِكَ “হে অন্তরসমূহের পরিবর্তন করার মালিক ! তুমি আমাদের অন্তরকে তোমার দ্বীনের উপরে প্রতিষ্ঠিত রাখো ।” এই দুআ তিনি দিনে-রাতে প্রায় সময়ই পাঠ করতেন _________________ অতীত যুগে এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে, এক সময়ের অনেক বড় পাপী লোক তওবা করে আল্লাহর বড় ওলী হয়েছেন । আবার এক সময়ের অনেক সৎ কর্মশীল, নেককার লোক পরবর্তী জীবনে পাপে লিপ্ত হয়ে গেছে, এমনকি কেউবা আবার কাফির হয়ে মুর্তাদ হিসেবে মৃত্যুবরণ করেছে, আল্লাহ আমাদেরকে হেফাজত করুন । সেইজন্য, প্রকৃত ঈমানদার ও বুদ্ধিমান লোকেরা নিজের খারাপ অবস্থায় মৃত্যুকে ভয় করে এবং ঈমানদার ও সৎ কর্মশীল অবস্থায় মৃত্যুর জন্য আল্লাহর কাছে বেশি বেশি দুআ করে । আমাদের উচিত স্যাইয়েদুল মুরসালীন মুহাম্মদ ﷺ এর সুন্নত মোতাবেক উপরোক্ত দুআটি বেশি বেশি পাঠ করা । এছাড়া হেদায়েতের উপর টিকে থাকার জন্য দুআ হিসেবে সুরা আলে-ইমরানের ৮-নং আয়াতে দুআ আপনারা মুখস্থ করে নিতে পারেন, এই দুআর অর্থ খুব সুন্দর এবং হৃদয়গ্রাহী । (নিচে আয়াত ও অর্থ দিলাম) উপরোক্ত বিষয়ে উদাহরণ হিসেবে এমন দুইটা ঐতিহাসিক ঘটনার বিবরণ সংক্ষেপে তুলে ধরলাম তাওবার আশ্চর্যজনক এক ঘটনাঃ- ফুযাইল ইবনে ইয়াজ (আল্লাহর রহমত তাঁর উপর বর্ষিত হোক) তওবা করে পাপের রাস্তা বর্জন করে পরবর্তী জীবনে ইলম অর্জন করে বড় আলেম হয়ে ফুযাইল ইবনে ইয়াজ রহি’মাহুল্লাহ ইসলামের ইতিহাসে অনন্য এক দৃষ্টান্ত আমাদের মাঝে রেখে গেছেন । তাবেয়ী বিদ্বান, আবেদ, যাহেদ হিসেবে প্রখ্যাত ফুযাইল ইবনে ইয়াজ প্রথম জীবনে ঈমানদার, নামাযী মুসলিম ব্যক্তি ছিলেন, কিন্তু তিনি সৎ কর্মশীল আল্লাহর কোন নেক বান্দা ছিলেন না । বরং, চুরি-ডাকাতির মতো বড় গুণাহর কাজে লিপ্ত থাকার জন্য কুখ্যাত ছিলেন । এক রাতে তিনি একটি বাড়িতে ডাকাতি করার জন্য দেয়াল বেয়ে টপকে বাড়ীতে ঢোকার সময় সেই বাড়ির একজন লোককে ক্বুরআনের এই আয়াত তিলাওয়াত করতে শুনেনঃ أَلَمْ يَأْنِ لِلَّذِينَ ءَامَنُوٓا أَن تَخْشَعَ قُلُوبُهُمْ لِذِكْرِ اللَّهِ وَمَا نَزَلَ مِنَ الْحَقِّ “যারা ঈমান এনেছে তাদের হৃদয় কি আল্লাহর যিকিরে এবং যে সত্য নাযিল হয়েছে তার জন্য বিগলিত হওয়ার সময় এখনো আসেনি ?” সুরা আল-হাদীদঃ ১৬ এই আয়াতে অন্তর্নিহিত বক্তব্য ফুযাইল ইবনে ইয়াজকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে আর তিনি চিন্তা করেন, আল্লাহ তাআ’লার এক বান্দা রাত জেগে ক্বুরআন তিলাওয়াত করছে আর আমি মানুষের বাড়িতে ডাকাতি করতে যাচ্ছি ? সেই মুহূর্তেই তিনি তাওবা করে উক্ত আয়াতে আল্লাহ তাআ’লার প্রশ্নের জবাবে বলে উঠেনঃ “হ্যা, আমার উপদেশ গ্রহণের এবং অন্তর বিগলিত হওয়ার সময় চলে এসেছে ।” ফুযাইল ইবনে ইয়াজ সেইদিন থেকে আন্তরিক তওবা করে পাপের রাস্তা ত্যাগ করেন এবং ইলম অর্জনে নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন । কালক্রমে তিনি একজন বড় আলেম, আবেদ ও যাহেদ ব্যক্তি হিসেবে বিখ্যাত হয়ে উঠেন । _________________ সালাফী আলেম থেকে মুরতাদ হিসেবে মৃত্যুবরণ করার একটি ভয়ংকর ঘটনাঃ আব্দুল্লাহ আল-কাসেমী (আল্লাহর অভিশম্পাত তার উপরে বর্ষিত হোক) আব্দুল্লাহ আল-কাসেমীর জন্ম হয়েছিলো ১৯০৭ সালে এবং মৃত্যু হয়েছিলো ১৯৯৬ সালে । প্রথম জীবনে সে একজন অগ্রগামী সালাফী তালিবুল ই’লম ছিলো, যে কিনা মিশরের আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের পথভ্রষ্ট সূফী আলেমদের বিদআ’তের সমালোচনা করে তাদের জবাব দিতেন । তিনি শায়খুল ইসলাম মুহা’ম্মদ বিন আ’ব্দুল ওহহাব রহি’মাহুল্লাহর দাওয়াতের সমর্থনে বই-পুস্তক লিখতেন এবং তাঁর বিরোধীতাকারীদের অসারতা ও গোমরাহী তুলে ধরতেন । হক্কের পক্ষে কথা বলা এবং বাতিলের বিরোধীতা করার কারণে একসময় তিনি আল-আযহার থেকে বহিঃষ্কারও হয়েছিলেন, কিন্তু নিজের ব্যাপারে উচ্চ ধারণা এবং অহংকারের কারণে পরবর্তী জীবনে আস্তে আস্তে তিনি কুফুরী এবং নাস্তিকতার দিকে ঝুঁকে পড়েন । এমনকি আরব বিশ্বে নাস্তিকতা, ইসলামের প্রতি বিদ্বেষ, জাতীয়তাবাদ, ধর্ম নিরপেক্ষতা মতবাদ প্রচার ও প্রসারের জন্য আব্দুল্লাহ আল-কাসেমি হচ্ছে শীর্ষস্থানীয় একজন ব্যক্তি । হেদায়াতে আসার পর অন্তর বক্র হয়ে যাওয়া থেকে আশ্রয় চাওয়ার জন্য ক্বুরআনী দুয়াঃ رَبَّنَا لاَ تُزِغْ قُلُوبَنَا بَعْدَ إِذْ هَدَيْتَنَا وَهَبْ لَنَا مِن لَّدُنكَ رَحْمَةً إِنَّكَ أَنتَ الْوَهَّابُ “হে আমাদের পালনপকর্তা ! আপনি হিদায়াত দেওয়ার পর আমাদের অন্তরসমূহকে বাঁকা করবেন না এবং আপনার পক্ষ থেকে আমাদেরকে রহমত দান করুন । আপনিই সকল কিছুর দাতা ।